সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কর্তৃক যে বোমা হামলা চালানো হচ্ছে তা ইতিহাসের পাশবিক ঘটনাগুলোর একটি। একুশ শতকের উত্তর আধুনিকতাবাদের এ যুগে এসে আমাদের যে নজির দেখতে হয়েছে আমেরিকার মদদে ইসরায়েলের চালানো হামলা তা আমাদের বিস্মিত করলেও অনেক দেশ এটাকে তাদের মনো বাসনায় এমনটাই লালন করে চলছেন। তাছাড়া গত ২২ দিন ধরে ফিলিস্তিনের নিজ ভূমিতে ইসরায়েল বোমা ফেলে শিশুসহ ৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিককে হত্যা করেছে প্রায় ১ লক্ষ লোক আহতসহ কয়েক লাখ লোক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে আর গোটা বিশ্ব বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো সেটা নির্বিকারে বোধহীন ভাবে দেখে যাচ্ছে। যেখানে আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ইসরায়েলের মানবতা বিরোধী অপরাধে শাস্তি হওয়ার কথা সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব তাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। যাদের উপর এ সন্ত্রাসী আক্রমণ চালাচ্ছে তাদেরকে বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী আর যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে তাদের বলা হয় আত্মরক্ষা করে চলছে তারা। বেলফোর ঘোষণার আলোকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ সালে মে মাসে যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয় তা যেন মধ্য প্রাচ্যের সাথে সামপ্রদায়িক বিষবাষ্পের স্থানী বীজ বপন করা।
২. মধ্যে প্রাচ্যের কথিত মুসলিম দেশ: মুসলিম বিশ্বের যে ৫৭ টি দেশ রয়েছে তার কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা হয় মধ্য প্রাচ্যকে। তাছাড়া নানা কারনেই মুসলিম রাষ্ট্রসহ সব রাষ্ট্রের কাছেই মধ্যে প্রাচ্যের আলাদা একটা তাৎপর্য রয়েছে। মধ্যে প্রাচ্যের দেশগুলোর খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল পেট্রোলসহ নানা প্রকার জ্বালানি সম্পদ সারা বিশ্বের মোড়লদের মোড়লীপনা হাত ছাড়া করে দিতে পারে সেটা তারা আরও শতবছর আগেই বুঝতে পেড়েছে। যেজন্য এই অঞ্চলের ঐক্য বিনষ্ট ও শক্তিকে বিভিন্ন বিভাজনে খন্ডিত করার লক্ষ্যে তাদের যে সূদুর প্রসারী যাত্রায় অংশ হিসেবে আজকের ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম তা মুসলিম তাত্ত্বিকদের প্রাথমিক অনুধাবনে না আসার দরুন বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। তা না হলে ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতদান কারী প্রথম মুসলিম দেশ তুরস্ক, আর প্রথম আর দেশ মিশর হওয়ার কোন তাত্ত্বিক উপলব্ধি আসে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো উপলব্ধি হওয়ার পরেও কি সেই বিভাজনের রাজনীতি থেকেই আমরা বের হয়ে আসতে পারছি? উত্তর হলো না। আর পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা ও তার মিত্ররা এক্ষেত্রে শতভাগ সফল। আর আমাদের কথিত হুঙ্কার শুধু দায় সারা বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ।
আমরা চাইলে কি পুনরায় সেই ১৯৭৩ সালের তেল অস্ত্রের আঘাতের সিগনাল কি পশ্চিমদের কর্ণকুহরে কম্পন সৃষ্টি করাতে পারবো না। পারবো। কিন্তু কথা হলো বিড়ালের গলায় ঘন্টা দিবে কে। কারণ পদলেহনকারী হয়ে যে ক্ষমতা আঁকড়ে আছি তার শিকলে যদি টান পড়ে। এই ভয়ে স্বয়ং মাহমুদ আব্বাসও নির্বিকার শাসকের ন্যায় নিশ্চুপ হয়ে সয়ে চলছেন। তাহলে তো সেই হীরক রাজার গল্পের মত, " রশি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।" তাই কেউ আর খান খান হতে চাচ্ছে না।
৩. জাতিসংঘ ও ভেটো ক্ষমতা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সারা বিশ্ব যে ধ্বংসলীলা ও প্রাণহানি দেখেছে তা থেকে বাঁচার জন্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জাতিপুঞ্জ। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা দেওয়াই ছিল যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর সেই পথে অন্যতম বাঁধা হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে প্রস্তাব পাশ হওয়া সত্বেও স্থায়ী সদস্যের যেকোনো একটা সদস্য রাষ্ট্রের ভেটো প্রদানের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষিত হয়ে যায়। আর যেখানে এই ভেটো ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স ও রাশিয়া। যার দরুন গত সপ্তাহে এত বর্বর হামলা চালানোর পরও আমেরিকার বিরোধিতার কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে একটা নিন্দা প্রস্তাবও পাশ হয়নি। অথচ ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেসামরিক এলাকায় একটি হাসপাতালে বিমান হামলা চালিয়ে একসাথে পাঁচশত নাগরিককে হত্যা করে যে যুদ্ধাপরাধ করেছে তার বিচার হওয়া উচিত ছিল জাতিসংঘের আদালতে। বরং আমরা দেখতে পেলাম জাতিসংঘের মহাসচিব আ্যন্থনী গুতেটাস ফিলিস্তিনের নাগরিকদের উপর মানবিক আচারণ করার আহ্বান করে নিজেই পশ্চিমাদের তোপের মুখে পড়েন। এটা চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের আলোকে সরাসরি যুদ্ধাপরাধ।
ভেটো নীতির এ সনাতন প্রথা জাতিসংঘকে শুধু অকার্যকরই করেনি বরং পশ্চিমাদের একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করেছে। এ নীতির সংস্কারে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে আর সোচ্চার হওয়া উচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বর্তমানে সারা বিশ্বে তাদের পররাষ্ট্র নীতির এজেন্ডা হিসেবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে যে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে সেটা অবশ্যই পুঁজিবাদী বিশ্বে সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। কিন্তু সেই নীতি কি সকল রাষ্ট্রের জন্য সমান নাকি যেখানে যেরকম স্বার্থ রয়েছে সেখানে সেরকম প্রয়োগ করতে হবে? সেই নীত কি পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরান, বাংলাদেশ, ফিলিস্তিনির গাজা,পশ্চিম তীর, জেরুজালেমসহ মধ্য প্রাচ্যের কিছু মুসলিম দেশের প্রতি আলাদা নীতি? তাহলে যেখানে আমেরিকা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে সেখানে প্যালেস্টাইনের প্রতি ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে কেন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আসল কথা হলো ইন্দোপ্যাসিফিকের ভূরাজনীতি, মধ্য প্রাচ্যের তেল নীতি আর ইউরোপের ন্যাটোনীতির উপর আমেরিকার মানবাধিকার নীতির সঙ্গা ভিন্ন ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী যেরকম নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল ঠিক তেমনি হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়েছে ইসরায়েল। যেখানে প্রতিদিন শতশত প্রাণহানি ঘটছে সেখানে স্বয়ং জো বাইডেন সাহেব নাকি সন্দেহ প্রকাশ করে যাচ্ছেন প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে। অথবা তার প্রথম দায়িত্ব ছিল হামলা বন্ধের জন্য ইসরায়েলের উপর চাপ প্রয়োগ করা এবং সেই সাথে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু সেখানে ন্যূনতম কোন প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ লক্ষ্য করলাম না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত নীতির যে পরাজয় হয়েছে ঠিক তেমনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে চীন, রাশিয়া, ইরান,তুরস্কের হাত ধরে মার্কিন নীতিরও পরাজয় দেখতে পাবে আগামী বিশ্ব।
মানবাধিকার কোন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকার নয় বরং মানবাধিকার হলো সম্মান ও নিরাপত্তার অধিকার।সেই সাথে এটা এক ধরনের প্রাকৃতিক ও সামাজিক অধিকার। আর মানবাধিকাররে দোহাই দিয়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তার কথা বলে ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমি থেকে হত্যা করে উচ্ছেদের যে মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে মার্কিনিসহ পশ্চিমা বিশ্ব আর যাইহোক এটা মানবাধিকারের সঙ্গা হতে পারে না। আগামীর বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থায় পশ্চিমা আগ্রাসী নীতির বিলুপ্ত ঘটে একটি সাম্য ও ন্যায়সম্মত পৃথিবী প্রতিষ্ঠার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা খুব বেশি দূরে নয়। সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলঙ্কজনক বিদায়, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা তারই নমুনাসরূপ।
মন্তব্য